আজকে এমন একজন মানুষের গল্প বললো যার চিন্তা ধারা মনে প্রানে ছিল বাংলাদেশের চলচিত্রের উন্নয়ন । ঢালিউড সিনেমায় দীর্ঘ সময় জনপ্রিয়তার শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখা নায়ক রাজ-রাজ্জাকের পর ঢালিউড যুবরাজ বলা হয় যাকে । যে মানুষটি তার ক্যারিয়ারে ৪০০ টিও অধিক চলচিত্রে অভিনয় করেছেন এবং যার ঝুলিতে রয়েছে শেষ্ট অভিনেতা হিসাবে ১টি জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, ৩টি মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কার । যার অভিনীত আম্মাজান চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। হ্যা বন্ধুরা এতক্ষনে হয়তো বুঝে গেছেন আমারা কার কথা বলছি , তিনি বাংলা সিনেমার অত্যন্ত জনপ্রিয় কিংবদন্তী নায়ক মান্না ।
মান্নার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ আসলাম তালুকদার তবে সবার কাছে তিনি মান্না নামেই অধিক পরিচিত । ১৯৬৪ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন মান্না। পিতার নাম নুরুল ইসলাম তালুকদার ও মাতা হাসিনা ইসলাম। মান্নারা দুই ভাই দুই বোন । মান্নার উচ্চতা ৬ফুট, ওজন ৭৮ কেজি ধর্ম ইসলাম এবং তার রাশি হলো ধনু রাশি । মান্না টাংগাইল বিন্ধু বাসিনী হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা কলেজে জিয়োলজি বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হন কিন্তু গ্যাজুয়েশান শেষ করা হয়নি অভিনয়ের কারনে । ব্যক্তিগত জীবনে মান্না তার কর্মজীবনের শুরুর দিকের সহ-অভিনেত্রী শেলী কাদেরের সঙ্গে ভালবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির সিয়াম ইলতিমাস মান্না নামে এক পুত্র সন্তান রয়েছে।
ছোট বেলা থেকেই চলচিত্রের প্রতি প্রচন্ড ঝোক ছিল মান্নার । কলেজে পড়ার সময় প্রচুর সিনেমা দেখতেন তিনি। বিশেষ করে নায়ক রাজ রাজ্জাকের সিনেমা হলেতো কথাই নেই । স্বপ্নদেখতেন তিনিও একদিন অভিনয় করবেন। ১৯৮৪ সালে তিনি এফডিসির নতুন মুখের সন্ধান কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে আসেন এবং প্রথম সুযোগটি করেদেন নায়ক রাজ রাজ্জাক এবং ছবির নাম ছিল “তওবা” এবং এই ছবিতে তার প্রারিশ্রমিক ছিল ২০০১ টাকা । ১৯৮৫ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত পাগলী চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র শিল্পে অভিষেক ঘটে যদিও তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র তওবা। এর পর অনেকগুলো ছবিতে পার্শ ও দ্বেত নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে ।তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য চলচিত্র ছিল মোনালিসার বিপরীতে শিমুল পারুল (১৯৮৫), রেহানা জলির বিপরীতে নিষ্পাপ (১৯৮৬), কবিতার বিপরীতে বাপ বেটা ৪২০ (১৯৮৮), চম্পার বিপরীতে ভাই (১৯৮৮), আমার জান (১৯৮৮), সুনেত্রার বিপরীতে বাদশা ভাই (১৯৮৯), কোবরা (১৯৮৯), চম্পার বিপরীতে গরীবের বন্ধু (১৯৯০), আম্মা (১৯৯০), রানীর বিপরীতে অবুঝ সন্তান (১৯৯০), ছোট বউ (১৯৯০), পালকী (১৯৯০), দুখী মা (১৯৯০) ।
প্রথম একক নায়ক হিসাবে মান্না ১৯৯১ সালে মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত কাসেম মালার প্রেম চলচ্চিত্রে চম্পার বিপরীতে অভিনয় করেন। এরপর ১৯৯২ সালে কাজী হায়াতের দাঙ্গা ও ত্রাস চলচ্চিত্রেও একক অভিনেতা হিসাবে অভিনয় করেন এবং ছবিদুটিতে তার অভিনয় ব্যাপক প্রশংশিত হয় । ছবিদুটো সুপারহিট এবং ব্যবসা সফল হয় । এরপর থেকে মান্নাকে আর পছনে ফিরে তাকাতে হয়নি । তিনি একেএকে উপহার দিতে থাকেন হিট সুপারহিট চলচিত্র ।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সিনেমা হলমুখী করার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন ঢালিউড সুপারস্টার মান্না। তার সিনেমায় বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের কথা উঠে এসেছে বারবার। বঞ্চিত মানুষের কথা সিনেমার পর্দায় সুনিপুণভাবে তুলে ধরে তিনি সবার মন জয় করেন। তাই তিনি ছিলেন আপামর জনসাধারণের প্রিয় নায়ক।
মান্না ২৪ বছরের কর্মজীবনে চার শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। মান্না একমাত্র নায়ক যিনি ১০০ এরও অধিক পরিচালক ও ৬১ জন নায়িকার সাথে ছবিতে অভিনয় করেছেন যা যে কোন অভিনেতার জন্য একটি বিরল রেকর্ড। তার অভিনীত আম্মাজান চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি বীর সৈনিক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং আম্মাজান চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসাবে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি তিনবার মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অর্জন করেন এবং বেশ কয়েকবার বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন।
মান্না অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- দাঙ্গা, লুটতরাজ, তেজী, আম্মাজান, আব্বাজান, বীর সৈনিক, শান্ত কেনো মাস্তান, বসিরা, খল নায়ক, রংবাজ বাদশা, সুলতান, ভাইয়া, টপ সম্রাট, ঢাকাইয়া মাস্তান, মাস্তানের উপর মাস্তান, বিগবস, মান্না ভাই, টপ টেরর, জনতার বাদশা, রাজপথের রাজা, এতিম রাজা, টোকাই রংবাজ, ভিলেন, নায়ক, সন্ত্রাসী মুন্না, জুম্মান কসাই, আমি জেল থেকে বলছি, কাবুলিওয়ালা ইত্যাদি।
অভিনয়ের পাশাপাশি একসময় প্রযোজনায় ও নাম লেখান এই গুনী অভিনেতা । তিনি কৃতাঞ্জলী চলচ্চিত্র নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি লুটতারাজ, স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ, দুই বধু এক স্বামী, আমি জেল থেকে বলছি, পিতা মাতার আমানতসহ মোট আটটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেন।
প্রযোজনার পাশাপাশি তিনি ছিলেন বাংলাদেশ চলচিত্র শিল্পি সমিতির সাধারন সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ।
মান্না ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর কয়েকমাস পর একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর চিকিৎসকদের অবহেলায় তার মৃত্যু হয়েছে, এমন অভিযোগে তার পরিবারের পক্ষ থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালের ছয় চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার শ্যালক রেজা কাদের।
মান্না আমাদের বাণিজ্যিক ছবির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় নাম হয়ে থাকবে। তাঁর অভিনয়, কথার ধরন সব কিছু মিলেই একটা আলাদা স্বতন্ত্র স্টাইল তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন। এমন কিছু ছবি আছে যার জন্য মান্না চিরদিন দর্শকদের মনে স্থান করে নিয়েছেন। মান্না ছাড়া হয়তো আমরা সেইসব ছবি পেতাম না। একটা সময় ছিল যখন ছবিতে শুধু মান্না আছে তাঁর কারনেই দর্শক হলে ছুটে গিয়েছিল, তাঁর কারনেই ছবিটি ব্যবসা সফল হয়েছিল। মান্না যে ছবিতে দুর্দান্ত সে ছবির কাহিনী যত গতানুগতিকই হোক না কেন সেই ছবি ব্যবসা করবেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। সমসাময়িক রাজনৈতিক পটভূমির সাহসী প্রতিবাদী গল্পের এমন কিছু ছবি মান্না আমাদের দিয়েছিলেন যা অন্য আর কোন নায়ক দিতে পারেনি ও আগামীতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে। যে ছবিগুলো আমাদের চলচ্চিত্রকে করেছে সমৃদ্ধ। আজ হলবিমুখ বাংলা চলচ্চিত্রের করুন সময়ে আরেকজন ‘মান্না’ কে খুব বেশী প্রয়োজন যার কারনে ছবি পাড়া আবার সরগরম হবে, প্রযোজক পরিচালকরা ব্যবসা করার সাহস পাবে সর্বোপরি বাংলা চলচ্চিত্র আবার জেগে উঠবে এমন আরেকজন ‘মান্নার আশায় পুরো বাংলা চলচ্চিত্র।
যতদিন বাংলা সিনেমা থাকবে ততদিন ঢালিউড সোনালী প্রজন্মের সর্বশেষ মহানায়ক, মেগাস্টার মান্না এদেশের চলচিত্র প্রেমীদের হুদয়ে অমর হয়ে থাকবেন । লাইফ স্টোরির পক্ষ থেকে আপনার বিদেহী আত্বার মাগফেরাত কামনা করছি ।
0 মন্তব্যসমূহ